রবিবার ৫ই মে, ২০২৪ ইং ২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভয়ঙ্কর ‘ব্লু হোয়েল’ গেমে আসক্ত তরুণ-তরুণীরা

আকাশবার্তা ডেস্ক :

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে আত্মঘাতি ‘ব্লু হোয়েল’ গেম। অনেকেই লিঙ্ক পাঠিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের এ চ্যালেঞ্জ নিতে উৎসাহিত করছেন। বাংলাদেশেও হানা দিয়েছে ভয়ঙ্কর গেম ‘ব্লু হোয়েল’। এরআগে এ গেমের বলি হয়েছেন বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মেধাবী তরুণ-তরুণী।
সম্প্রতি ভারতজুড়েও চলছে ‘ব্লু হোয়েল’ আতঙ্ক। সর্বশেষ ‘ব্লু হোয়েল’ গেমের শিকার হয়েছে বাংলাদেশের এক কিশোরী। গত বৃহস্পতিবার ফার্মগেটের হলিক্রস স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার লাশ উদ্ধার করা হয় তার পড়ার কক্ষ থেকে। পরে স্বর্ণার বাবা গণমাধ্যমকে জানান, পড়াশোনার জন্য সে ব্যবহার শুরু করে ইন্টারনেট। কয়েকবছর আগে থেকেই এনড্রয়েড মোবাইল ফোনও ব্যবহার শুরু করে। ফেসবুকসহ সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছিল। এরই মধ্যে সবার অজান্তে সে ঢুকে পড়ে ইন্টারনেটের এই নিষিদ্ধ গেমসে।

তরুণ-তরুণীরা যখন এ ভয়ঙ্কর গেমটি খেলতে ব্যস্ত, তখন অভিভাবকদেরও মনে হয়নি এমন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু বর্তমানে এ গেমটি রীতিমত মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে অভিভাবকদের মধ্যে। প্রাণঘাতি ‘ব্লু হোয়েল’ বা নীল তিমি গেমটি ২০১৩ সাল থেকে শুধু রাশিয়াতেই এ পর্যন্ত ১৮১ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সাম্প্রতিককালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একাধিক দুর্ঘটনা এবং আত্মহত্যার ঘটনায় নাম ছড়িয়েছে এ সোস্যাল গেমিংয়ের। এক পরিসংখ্যানগত তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, গত তিনমাসে রাশিয়া এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাতেই ১৬ জন তরুণী আত্মহত্যা করেছে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইটালি ও ভারতে বেশ কয়েকজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এই গেমের প্রতি চরম আসক্তি চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে দেশের মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে।
তাদের মতে, খেলাধূলার মাঠে না যাওয়া, ঠিকমত ক্লাসে না যাওয়া, ক্লাসে অমনোযোগিতা, যথাসময়ে ঘুম থেকে না ওঠা, খাওয়া-দাওয়াসহ সবই যেন যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর তাই অনলাইন গেমের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আসক্তি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ব্লু হোয়েল’ একটা এমন গেম যা মানুষকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। কিশোর-কিশোরী ইন্টারনেটে কোন বিষয়ে সময় দিচ্ছে তা লক্ষ রাখতে হবে। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে যদি সম্ভব হয় এ ধরনের গেম কোনোভাবেই তরুণরা ডাউনলোড করতে না পারে সে ব্যবস্থা করা। এ গেম প্রতিরোধে মিডিয়াকে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে।

জানা যায়, জনপ্রিয় গেম ‘ক্যান্ডিক্রাশ’র মতই ভয়ঙ্কর এই গেমে রয়েছে বিভিন্ন ধাপ। তবে ৫০তম ধাপে এসে গেমটি সমাপ্ত হয়। আর ৫০তম ধাপটি হচ্ছে আত্মহত্যা। প্রথমদিকে একই গেমের কিছু সহজ কাজ থাকে। এক বা একাধিক কিউরেটর দ্বারা চালিত হয় এ গেম। কিউরেটরদের নির্দেশেই গেমের এক একটি নিয়ম মেনে চলতে থাকে অংশ গ্রহণকারীরা। নিয়মানুযায়ী একবার এ গেম খেললে আর বের হয়ে আসা যায়না। কেউ বের হতে চাইলেও তাদের চাপে রাখতে পরিবারকে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয় বলে আলোচনা আছে। এ গেমের বিভিন্ন ধাপে রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
যেমন ব্লেড দিয়ে হাতে তিমির ছবি আঁকা, সারাগায়ে আঁচড় কেটে রক্তাক্ত করা, কখনো ভোরে একাকি ছাদের কার্নিশে ঘুরে বেড়ানো, রেল লাইনে সময় কাটানো, ভয়ের সিনেমা দেখা ইত্যাদি। চ্যালেঞ্জ নেওয়ার পর এসব ছবি কিউরেটরকে পাঠাতে হয়। ২৭তম দিনে হাত কেটে ব্লু হোয়েলের ছবি আঁকতে হয়। একবার এই গেম খেললে কিউরেটরের সব নির্দেশই মানা বাধ্যতামূলক। সবধাপ পার হওয়ার পর ৫০তম চ্যালেঞ্জ হলো আত্মহত্যা। এ চ্যালেঞ্জ নিলে গেমের সমাপ্তি। রাশিয়ায় শুরু হলেও এই গেমের শিকার এখন এশিয়ার অনেক দেশ। সাধারণভাবে গোপন গ্রুপের মধ্যে অপারেট করা হয় এ গেম। এ ক্ষেত্রে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপের মতো জনপ্রিয় সোস্যাল ফ্লাট ফরমকে কাজে লাগায় এডমিনরা।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম সম্প্রতি তার ফেসুবকে ভয়ঙ্কর এ গেমটির কিছু লক্ষণ তুলে ধরে একটি স্ট্যাটাস দেন। এরপর তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন কয়েকজন অভিভাবক। তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ওই সংবাদে ‘ব্লু হোয়েলে’ আসক্তদের লক্ষণ উল্লেখ ছিল।
তিনি আরও জানান, সংবাদটি দেখে এক কিশোরের ভাই আমাকে তার ছোট ভাইয়ের হাতের ছবি মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছে যা ‘ব্লু হোয়েল’ আসক্তদের উপসর্গের সঙ্গে মিলে গেছে। তার বড় ভাই তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে অপর কিশোর চিকিৎসকের কাছে যেতে অপারগতা জানিয়েছে বলেও জানান তাজুল ইসলাম।

সম্প্রতি বাংলাদেশে আত্মহত্যা করা কিশোরী অপূর্ব বর্ধণ স্বপ্নার বাবা অ্যাডভোকেট সুব্রত বর্মণ জানান, মেয়ের মৃত্যুর পর আমি ব্লু হোয়েলের বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করি। জেনেছি যে, রাশিয়ার এক সাইকিস্ট সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এই গেমটি উদ্ভাবন ও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। এরইমধ্যে নাকি বাংলাদেশে আমার মেয়েসহ অন্তত ৬১ জন ব্লু হোয়েলের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে। এটি একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। বাংলাদেশের আইনে যদি এ অপরাধের জন্য উদ্ভাবকের বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ থাকে আমি মামলা করব। এ গেমে একবার ঢুকলে আর বের হওয়া যায়না। তাই আমি অনুরোধ করবো কেউ যেন কৌতূহলের বশেও এ গেমসে না ঢোকে।

এদিকে, অভিভাবকদের বাড়তি নজরদারির পাশাপাশি ইন্টারনেট গেইটওয়ে থেকে গেমটির লিঙ্ক মুছে ফেলার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের এ মৃত্যু ফাঁদ থেকে রক্ষা করা সম্ভব বলে মনে করেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।

এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আলিমুজ্জামান বলেন, ব্লু হোয়েল গেমসগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ একটি বন্ধ করলে অন্য একটি তৈরি হয়। তারপরও আমরা জনসচেতনতা তৈরি করছি। আর বিটিআরসির সাথে কথা বলছি। সর্বোপরি ভয়ঙ্কর এ গেমটি নিয়ে আমাদের কাজ চলছে।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে রাশিয়ায় ব্লু হোয়েল গেমের কিউরেটর সন্দেহে ফিলিপ বুদেকিন নামের ২২ বছরের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জেরায় ফিলিপ স্বীকার করে, এ চ্যালেঞ্জের যারা শিকার তারা এ সমাজে বেঁচে থাকার যোগ্য নয়। তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আমি সমাজ সংস্কারকের কাজ করছি।

কীভাবে বুঝবেন কেউ ব্লু হোয়েল আসক্ত :
যেসব কিশোর-কিশোরী ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে তারা সাধারণভাবে নিজেদের সবসময় লুকিয়ে রাখে। স্বাভাবিক আচরণ তাদের মধ্যে দেখা যায়না। দিনের বেশিরভাগ সময় তারা কাটিয়ে দেয় সোস্যাল মিডিয়ায়। থাকে চুপচাপ। কখনো আবার আলাপ জমায় অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে। গভীর রাত পর্যন্ত ছাদে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় অনেককে। একটা সময়ের পর নিজের শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলতে থাকে তারা।

     এই বিভাগের আরও সংবাদ

আর্কাইভ

মে ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« এপ্রিল    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১