রবিবার ১৯শে মে, ২০২৪ ইং ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাসিয়া ফাঁসিও না

 

দুনিয়ায় মেলা পদের হাসি আছে। মুচকি হাসি, অট্টহাসি, মিনমিনে হাসি, স্মিত হাসি, শয়তানি হাসি, ক্রুর হাসি, ছ্যাবলা হাসি, মিচকা হাসি—কত পদের কথা বলব?

একেকজনের হাসির কায়দা একেক রকম। একেক হাসির মাজেজা একেক রকম। এক কিসিমের সাথে আরেক কিসিমের মিল নাই। একই আড্ডায় একই ব্যক্তির হাস্যকর কথায় একজন হাসে দাঁত কেলিয়ে। একজন হাসে মিটমিটিয়ে। একজন হাসে মুখ চেপে। অন্যজন হাসে অন্য কিছু চেপে। হাসতে হাসতে কারও পেটে খিল ধরে। কারও দম আটকে যায়। কেউ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়।

তিলোত্তমা প্রেমিকার হাসি দেখে আনন্দের চোটে প্রেমিকেরও মুখে হাসি ধরে না। আবার এই হাসি দেখে কারও গা জ্বলে জ্বলে যায়।

এর বাইরে আরেক পদের হাসি আছে। সেটা বড় ভয়ানক হাসি। সেটার নাম হায়েনার হাসি। এই হাসিতে বেশি শব্দ হয় না। অস্পষ্ট কিচকিচ আওয়াজ হয়। যিনি হাসিটা দেন তাঁর চোখ দুটো কিঞ্চিৎ ছোট হয়ে আসে। দাঁত সামান্য বিকশিত হয়। যাঁরা সেই হাসির মর্মার্থ ধরতে পারেন, তাঁদের রক্ত ভয়ে হিম হয়ে আসে।

হাসির উদ্ভব, ইতিবৃত্ত ও ক্রমবিকাশের খবর নিতে উইকিপিডিয়ায় উঁকি মেরেছিলাম।

উইকিপিডিয়া অন্য রকম এক হাসির কথা বলছে, ‘বিশ্বজুড়ে হাসি যোগাযোগের একটি অন্যতম হাতিয়ার ও মাধ্যম। প্রাণীদের মধ্যে দাঁত প্রদর্শন করাকে হাসির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে হলেও প্রায় সময়ই তা হুমকি বা সতর্ক করা হচ্ছে—এমন অর্থ বহন করে। শিম্পাঞ্জিদের মাঝে ভয়ের প্রতীক হিসেবেও হাসি দেখা যায়।’

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বিরলপ্রজ হাসির ভিডিওচিত্র ভেসে বেড়াতে দেখা গেছে। ভুল জায়গায় ভুল হাসি দিয়ে হাসিদাতা শুধু যে হাসির পাত্র হয়েছেন তাই নয়, তিনি দেশের অনেকের গা-জ্বালা অবস্থা সৃষ্টি করেছেন। বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে শিশুর প্রাণহানির খবরের প্রতিক্রিয়ায় মুখ ফসকে তাঁর মুখ থেকে হাসি বেরিয়ে গিয়েছিল। তিনি শিশুর সারল্যে হাসতে হাসতে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘প্রতিবেশী দেশে শ শ লোক বাসে চাপা পড়ে মরছে, তারা কোনো টুঁ শব্দ করে না। আর আপনারা দুই-একজনের মৃত্যুর কথা নিয়ে কিসব হাস্যকর প্রশ্ন করেন?’

প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে—নিউটন সাহেবের এই সূত্র এইখানে বিদ্যুৎ-গতিতে কাজ করেছে। অ্যাকশনে রি-অ্যাকশন। সেখান থেকে চেইন রি-অ্যাকশন। আঘাতে প্রতিঘাত। শিশুমৃত্যু নিয়ে হাসি-তামাশা বিচ্ছুবাহিনী মানবে কেন? তারা নেমে এল রাস্তায়। তারা সরল মনে কেঁচো খোড়া শুরু করল। কিন্তু গর্ত থেকে একের পর এক কেউটে বেরোতে থাকল। তারা গাড়ির লাইসেন্স চাইল। দেখা গেল ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়। সরষের মধ্যে ভূত। মন্ত্রী, আমলা, সাংবাদিক, সচিব, পুলিশ—সব কিসিমের লোকের এক সমস্যা। গাড়ির লাইসেন্স চাইলেই তাঁরা দাঁত কেলিয়ে বলেছেন, ‘নাই তো!’

পোলাপান জানে, দেশের সাধারণ মানুষ তাঁদের লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে, এই কারণে তাঁরা সেন্স হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁরা ‘ট্রুথ’ ঢাকছেন ‘লাই’ দিয়ে।

হাতেনাতে ধরা পড়ার পর অনেক কেউকেটাকে লাজুক লাজুক ভঙ্গিমায় কুটুর কুটুর করে হাসতে দেখা গেছে।

দুনিয়ার মানুষ তাঁদের সেই গালে টোল পড়া সলজ্জ হাসি দেখেছে।

চারপাশে ঘিরে থাকা দস্যি ছেলেমেয়েরা যখন বলছে, ‘আংকেল, আপনার লাইসেন্স?’ তাঁদের মুখে সেই মিনমিন করা হাসি ছাড়া কোনো জবাব নেই। দু-একজন অবশ্য দীর্ঘদিনের অভ্যাস (আসলে বদভ্যাস) মতো চালাকি করা কূটনৈতিক মার্কা প্যাঁচের ভাষায় জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এই ছেলেগুলো তাঁদের বুঝিয়ে দিল, এটা সচিবালয়ের আমলাতান্ত্রিক এলাকা না। এটা জনপথ।

সরকারি কর্মচারীরা ভুলে গেছেন তাঁরা পাবলিক সার্ভেন্ট। সোজা বাংলায় পাবলিকের সেবক। কারও হাতে লাইসেন্স নাই বলে এখন সেবক মনিব হয়ে হি হি করে হাসছেন।

‘যত হাসি তত কান্না/ বলে গেছেন রাম সন্যা’। প্রবাদকথিত এই রাম সন্যা লোকটার ঠিকানা জানা থাকলে দাদাকে কদমবুচি আর প্রণাম একযোগেই করে আসতাম। তার ‘যত হাসি তত কান্না’-বিষয়ক জীবনঘনিষ্ঠ বাণীর মর্মার্থ এখন বোঝা যাচ্ছে।

আমরা যারা আমড়া কাঠের ঢেঁকি, মানে প্রাপ্তবয়স্ক আমজনতা, তারা সব দেখে অতি দুঃখে কাষ্ঠ হাসি হাসছি। সরকারের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারও এই শিশুদের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার সৎ সাহস হয়নি। তাঁদের প্রশ্নের জবাব নেতাদের কাছে নেই।

তাই অবাধ্য কিশোরদের ‘বোঝাতে’ লাঠি হাতে রাস্তায় নেমেছে ‘সচেতন’ যুবসমাজ। তারা ‘মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি’ বলে শিশু দমন অভিযানে নেমেছে।

বড়দের বড় ভয়, এই ছোটরা আজ গাড়ির লাইসেন্স দেখতে চাইছে, কাল যদি অন্য অনেক কিছুর লাইসেন্স চেয়ে বসে! সে সময় সবকিছু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন হবে।

তারা যদি বলে বসে, ‘আংকেল, দেখি আপনার লাইসেন্স!’

এখনো এই প্রশ্ন সামনে নিয়ে তারা আসেনি। আসবে না সে গ্যারান্টি নেই। সুতরাং ভুল জায়গায় ভুলভাল হাসি বন্ধ করা দরকার। সর্বস্তরে লাইসেন্সহীন মাতব্বরি বন্ধ করা দরকার। নইলে এই বিচ্ছুবাহিনীর কাছে জবাব না দিয়ে এক পা-ও সামনে যাওয়া যাবে না। তখন কোনো হাসিতেই আর কাজ হবে না।

সারফুদ্দিন আহমেদ : লেখক ও সাংবাদিক।

     এই বিভাগের আরও সংবাদ

আর্কাইভ

মে ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« এপ্রিল    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১