রবিবার ১৯শে মে, ২০২৪ ইং ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গণতন্ত্র না উন্নয়ন?

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী :


গণতন্ত্র না উন্নয়ন চাই এমন একটা প্রশ্ন আমাদের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন গণতন্ত্র চাই আবার কেউ কেউ বলছেন উন্নয়ন চাই, কেউ কেউ বলছেন গণতন্ত্রও চাই, উন্নয়নও চাই। কোনও কোনও বন্ধুর মতামত লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন ইরাকে-লিবিয়ায় উন্নয়ন তো হয়েছে কিন্তু গণতন্ত্র ছিলো না বলে দেশ-দু’টা ভেঙে গেছে। লি কুয়ান সিঙ্গাপুরে গণতন্ত্রের অবাধ গতি মেনে চলেননি- মাহাথির মুহাম্মদও মালয়েশিয়ায় গণতন্ত্রের গতিকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে দেননি। এ কারণেই সিঙ্গাপুরে এবং মালয়েশিয়ায় উন্নয়ন হয়েছে।
কোনও কোনও লেখক বলেছেন আইয়ুব খানের উন্নয়নের দশ বছর পূর্তির পরেই পাকিস্তান ভেঙে গেছে- গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে। কারও কারও উন্নয়ন প্রীতির কথা শুনে কেউ কেউ গণতন্ত্রপ্রীতির এমন বাজনা বাজানো আরম্ভ করেছেন যে তাদের লেখা পড়লে মনে হয় গণতন্ত্রই যেন সকল রোগের মহাঔষুধ। একজনের লেখায় যুক্তি দেখানো হলো লি কুয়ান আর মাহাথির শাসনে তো সিঙ্গাপুরে বা মালয়েশিয়ায় দুর্নীতি ছিলো না। অর্থাৎ ভাবখানা এমন যে দুর্নীতি না থাকলে গণতন্ত্রহীনতা কোনও দোষের বিষয় নয়। কেউ কেউ গণতান্ত্রিক আদর্শ ও তার সৌন্দর্য বর্ণনায় যে রীতিনীতির বয়ান তাদের লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তা দেখে গ্রীক দেশের এক প্রাচীন কথা মনে পড়েছে। রাষ্ট্রের প্রশ্নে সক্রেটিসকে যখন প্রশ্ন করা হলো তোমার আদর্শ রাষ্ট্র কি কোথাও বাস্তবায়িত হয়েছে কিংবা এটা বাস্তবায়িত করা কি সম্ভব? তখন সক্রেটিস জবাব দিয়েছিলেন, তাতে কিছু আসে যায় না। তাহলেও আমাদের এ রাষ্ট্র আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে স্বর্গে  দীপ্যমান থাকবে। কেউ যদি সক্রেটিসের মতো গণতন্ত্রের রূপগুণের কথা স্বর্গের জন্য বর্ণনা করে থাকেন তবে কারও কিছু বলার থাকে না। মত্যের অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবতার আলোকে কোনও আলোচনা পেশ করাই হচ্ছে প্যাগম্যাটিক আলোচনা, আর এ আলোচনা দেশ ও দেশের মানুষের উপকার হয়।
বাংলাদেশে আমরা দু’টি পক্ষকে অবলম্বন করে বিভক্ত হয়ে গেছি। আমরা আমাদের আলোচনাকেও নিজ নিজ পক্ষের সুবিধা প্রাপ্তির জন্য পেশ করে থাকি। আসলে এতে সমাজের কোনও উপকার হচ্ছে না। আমাদের শ্রমও পশুশ্রম হচ্ছে। কলম তরবারির চেয়েও ধারালো। ফরাসী বিপ্লব তো লেখনীর ফসল। আমরা বাংলাদেশে এতোগুলো লেখক দিনের পর দিন লিখে যাচ্ছি কিন্তু সমাজ আমাদের লেখা থেকে তেমন কোনও উপকার পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
মানুষের সামাজিক জীবনের মূল যে তার জীবনধারনের চেষ্টা তথা তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সে কথা প্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত বিস্তৃত। মানুষ যখন রাষ্ট্র গঠন করতে শিখেনি তখনও তার প্রাথমিক দৃষ্টি ছিলো তার নিজের ক্ষুধা- তৃষ্ণা প্রতি। কারও ক্ষুদা তৃষ্ণাকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। ক্ষুধা তৃষ্ণা নিয়েই মানব জীবনের আবর্তন শুরু হয়েছিলো। এ আবর্তনের কারণেই মানুষ সমাজ গঠন করেছে, সমাজ থেকে রাষ্ট্র গঠন করেছে। মানুষ যখন রাষ্ট্র গঠন করেছে তখন তার অভিব্যক্তি ব্যাপক হয়েছে।
মানুষের প্রয়োজনে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে মানুষ নয়। সুতরাং রাষ্ট্রকে মানুষের প্রয়োজন মিটাতে হয়। আধুনিক কালে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজন ব্যাপক হয়েছে। রাষ্ট্র যদি মানুষের প্রয়োজন মিটাতে না পারে তবে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে যায়। রাষ্ট্রকে উন্নয়নের দিকে মনযোগী হতে হয় তার মানুষের প্রয়োজনে। সুতরাং গণতন্ত্রও উন্নয়ন-এর বিতর্ক আরম্ভ হলে পণ্ডিতেরা বলেছেন যে দেশে জিডিপি তিন হাজার ডলারের ভেতর তাদের পক্ষে গণতন্ত্র রক্ষা করা সম্ভব। গরীবের পক্ষে গণতন্ত্র রক্ষা করা সম্ভব নয়। “দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে গণতন্ত্র”-এ বিষয়টা নিয়ে ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যাডাম প্রোজওরস্কি এবং ফার্নাডো লিমেস্কি গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে গড় মাথাপিছু আয় ১৫০০ ডলার না হলে গণন্ত্ররত টেকা মুশকিল। এ দু-রাষ্ট্র বিজ্ঞানী বলেছেন রাষ্ট্র নাকি ধনী হয়ে গেলে গণতন্ত্র অমরত্ব লাভ করে। তারা ৫৯টি দরিদ্র গণতান্ত্রিক দেশের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন ৩৯টি দেশে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। তারা বলেছে দরিদ্র দেশগুলোর মাঝে ভারতে শুধু গণতন্ত্র টিকে আছে।

আমার এ লেখা উন্নয়ন এর প্রীতির কথা যারা বলছেন তাদের সমর্থন যোগানোর জন্য বা যারা গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয় বলছেন তাদের বিরুদ্ধাচারণের করার উদ্দেশ্যে লেখা নয়। দীর্ঘদিনব্যাপী গণতন্ত্র ও উন্নয়ন সম্পর্কে কলামিস্টের যে সব লেখা পড়েছি, বিজ্ঞজনদের যে সব আলোচনা শুনেছি তার সারমর্ম নিয়ে ‘গণতন্ত্র না উন্নয়ন’ এর মতো একটা স্পর্শকাতর বিষয়ে আমার জ্ঞানমত একটা আলোচনা করার চেষ্টা করেছি মাত্র।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্র ইউলসন বলেছেন বিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিশ্বকে গণতন্ত্রের জন্য নিরাপদ করা। আমার মনে হয় তিনি যদি জীবিত থাকতেন তবে তিনি এখন বলতেন একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিশ্বের জন্য গণতন্ত্রকে নিরাপদ করা। সম্প্রীতিক সময়ে আরব বিশ্বের দেশগুলো গণতন্ত্রের দিকে আসার একটা উন্মাদনা আমরা লক্ষ করেছি-এ-উন্মাদনার ফল যা হয়েছে তা মোটেই সুখকর হয়নি।

লিবিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া সর্বত্র এখন গৃহযুদ্ধ চলছে। এদেশগুলোর সমাজ জীবনও ছারখার হয়ে গেছে। এ এলাকায় গৃহযুদ্ধ কখন শেষ হবে তা সঠিক করে বলা মুশকিল। আরব বিশ্বে গণতন্ত্রকে নিরাপদ করা সম্ভব হলো না। বরঞ্চ গণতন্ত্রের উন্মাদনা আরব বিশ্বকে বিধ্বস্ত করে ফেললো। আইজেন হাওয়ার যখন প্রথম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তখন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মিটিংয়ে অ্যালেন ডোলাস আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে ছিলেন। তখন প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার বলেছিলে, ‘আপনি মরুভূমির আরবদের সাথে কিছুদিন কাটালে বুঝতে পারবেন তারা স্বাধীনতা বা মানবিক মর্যদা ইত্যাদি বুঝে না। দীর্ঘদিন এক নায়কতন্ত্রের অধীনে জীবন কাটিয়েছে। তারা মুক্ত, স্বাধীন সরকার কিভাবে পরিচালনা করবে?’

আসলে যে কোনও বিষয়ে মানুষ একদিনে প্রস্তুত হয়ে যায় না তার প্রস্তুতির জন্য দীর্ঘ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ ছাড়া মানবিক প্রস্তুতি অর্জন ও সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের উন্মেষ হয়েছিলো গ্রীসে। কমবেশ ভারতেও গণতন্ত্রের চর্চা ছিলো। কিন্তু আধুনিক গণতন্ত্রের বিকাশ হয়েছে বৃটেনে।

বৃটেনে একদিনে সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্রাইটেরিয়ার চেয়ে বৃটেনে ভোটার হওয়ার ক্রাইটেরিয়া বেশি কঠিন ছিলো। মাত্র ২% ভোটার পার্লামেন্টের ৫০০ সদস্য নির্বাচিত করতেন। ভোটার ভেড়েছে ধীরে ধীরে। বৃটেনে নারীরা ভোটের অধিকার পেয়েছে মাত্র ৭০/৭৫ বছর আগে।

দীর্ঘ প্রশিক্ষণের কারণে বৃটেনের গণতন্ত্রে-নির্বাচনে, নির্বাচনে ভোটারদের প্রার্থী বাছাইয়ে, তেমন কোনও ত্রুটি বিচ্যুতি দেখা যায় না। অথচ ভারতে, বাংলাদেশে, পাকিস্তানের নির্বাচনে ৭ খুনের আসামীও নিবাচন করতে পারে, আবার নির্বাচিতও হয়। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বনদস্যু ফুলন দেবীও নির্বাচিত হয়েছিলো।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা হয়ে আসছে বহুদিন ধরে। আমাদের দেশের সাথে পশ্চিমাদেশের গণতন্ত্রের চর্চার ব্যাপারে তেমন কোনও ব্যাপকভাবে অসামঞ্জস্য যে রয়েছে তা নয়। তবে যে পার্থক্যটা আমরা উপলব্ধি করি তা হচ্ছে সাংবিধানিক উদারতাবাদ সংক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রশিক্ষণগত জ্ঞানের অভাব সরকারি পক্ষ এবং বিরোধীপক্ষ পরস্পর আলাপ-আলোচনা, সমঝতা ইত্যাদি সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী নয়। একটা সরকার পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হলো কিন্তু বিরোধী পক্ষ পাঁচ বছর তাকে টিকে থাকতে দিতে চায় না। ঠুনকো অজুহাতে দেশ অচল করে দিতে চায়- আর যারা সরকারের থাকে তারা প্রতিরোধে শক্তি প্রয়োগ করে থাকে। অনেকে অজ্ঞতা বশত এটাকে সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ বলে বর্ণনা করে। আসলে এটা হচ্ছে বিরোধী পক্ষের পদক্ষেপ। সরকার উৎখাত করার আর সরকার পক্ষের সরকার টিকিয়ে রাখব-এ দুয়ের সংঘাত। এতে দেশে উন্নয়নের ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটে। বিদেশি বিনিয়োগ আসে না।

গত তিন বছরব্যাপী দেশে প্রবৃদ্ধি ঠিক রয়েছে। কোনও বিদেশি বিনিয়োগের কারণে নয় পর্যাপ্ত সরকারি বিনিয়োগের কারণে। বিরোধী পক্ষকে শায়েস্তা করার সরকারের অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ যেমন গণতন্ত্র চর্চার পথে অন্তরায় তেমনি বিরোধী পক্ষের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বে সরকার উৎখাতের আন্দোলনও গণতন্ত্রের চর্চাকে ব্যাহত করে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চার পথে সমস্যা এটাই। গণতন্ত্র নিজেও একটা একক মতাদর্শ অন্যান্য মতাদর্শের মতো গণতেন্ত্ররও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা উত্তরণের জন্য সকল পক্ষের নিষ্ঠা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন তার অভাব হলেই গণতন্ত্রের বিপর্যয় আসে। বাংলাদেশেরই সকল পক্ষই-এ বিষয়টার ব্যাপারে সচেতন নন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংখ্যা গরিষ্ঠের ইচ্ছা এবং সংখ্যালঘিষ্ঠের অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার সংষ্কৃতি প্রচলিত হয়নি। যে কারণে কী রাজনৈতিক কর্মী কী সাধারণত মানুষ সকলের রাজনীতি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পোষণ করে চলে। যা কখনও উত্তম নয়। আমাদের বুদ্ধিজীবিদের পক্ষপাতিত্বমূলক কথাবার্তার কারণে পরিচ্ছন্ন রাজনীতির আলোটা থেকে অনেকে বঞ্চিত।

লি কুয়ান সিঙ্গাপুরের ভাগ্য এবং মাহাথির মালয়েশিয়ার ভাগ্য পরিবর্তনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাতে তারা সফল হয়েছেন সত্য কিন্তু গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন ইচ্ছে মতো। কিন্তু আমার মনে হয় সরকার ও বিরোধী দল যদি নিজেদেরকে শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে চলার প্রয়াসী হয় এবং আইনের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় উভয়ই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয় তবে গণতন্ত্রও উন্নয়ন হয়ত পাশাপাশি চলতে পারবে। ক্ষমতা থেকে বাইরে থাকলে বিরোধীদলকে পাগলা হাতির মতো আচরণ করলে চলবে না।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com

     এই বিভাগের আরও সংবাদ

আর্কাইভ

মে ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« এপ্রিল    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১